আমরা যদি একটা পৃথিবী কল্পনা করি যা বৃক্ষহীন, জলাভূমিহীন এবং বৃষ্টিশূন্য, প্রথমেই যা মাথায় আসবে তা হলো ধূসর, জীবনবিহীন একটি গ্রহ, যেখানে প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই। আদিম মানুষ প্রকৃতির সাথে সমন্বয় রেখে বসবাস করতো। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ নিজের হাতে এই সমন্বয় নষ্ট করে নতুন সব প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এখন ৪১৫ পিপিএম যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে দিন দিন এই পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
যদি বাংলাদেশের কথাই ধরি, মাত্র এপ্রিল মাসে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে তাপমাত্রা পার করে এসেছে দেশ,যার প্রভাবে পশু-পাখি সহ মানব জীবন হয়ে উঠেছে দূর্বিষহ। শ্রমজীবি মানুষের কষ্ট চোখে দেখার মত ছিলনা। শুধু যে গরম তাই নয়, গত কয়েক বছরে প্রকৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। শীত কালে শীত নেই, বর্ষাকাল নেই বৃষ্টি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তীব্র বায়ুদূষন। বাংলাদেশের নাম এখন প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উল্লেখিত হয়, সেটি বায়ুদূষণে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে থাকার জন্য। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দৃশ্যমান হয়েছে দেশে মৃত্যুর প্রায় ৩২% নাকি দূষণ প্রক্রিয়ার পরিণতি। আজকের পরিবেশের এই অস্বাভাবিকতার জন্য মানুষের কৃতকর্মই দায়ী বলা চলে। নির্বিচারে আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত এক অমূল্য উপহার- প্রকৃতির বিনাশ করছি, এতে বিভিন্ন প্রাণীকূলসহ মানব সভ্যতা প্রকৃতির রোষানলে পড়ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য এখন আর ঠিক নেই। বাংলাদেশের ষড়ঋতু যেন হারিয়ে গিয়েছে বছরজুড়ে তীব্র তাপদাহের ডামাডোলে।
উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করতে গিয়ে আমরা আসলে কতখানি পিছিয়ে যাচ্ছি তা বোঝা যায়, যখন দেখি বর্তমানে দেশে জনপ্রতি বনভূমির পরিমাণ প্রায় ০.০২ হেক্টর মাত্র। আমরা যদি অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশে প্রকৃতিকে না রেখে উন্নয়নের মিছিলে অংশগ্রহণ করি তবে সেই উন্নয়ন মানব সভ্যতার জন্য কতটা যৌক্তিক হবে সেটা বিবেচনার বিষয়। প্রায়শই দেখি রাস্তায় গাছ কেটে, জলাশয় ভরাট করে, খেলার মাঠ দখল করে উন্নয়নের কাজ চলছে। যেখানে তৈরী করা হচ্ছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত বহুতলভবন, আবাসিক হোটেল, সোসাইটি এবং সুপারমার্কেট। উন্নয়নের যে পরিকল্পনায় প্রকৃতির কল্যাণ বিবেচনা করা হয়না, সে পরিকল্পনার কোন ভবিষ্যৎ নেই। কয়েকদিন আগেই বড় বড় বিশ্ব নেতাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জলবায়ুবিষয়ক (কপ-২৭) সম্মেলন। নানা ধরনের সমীক্ষা, গবেষণা প্রতিবেদন, সেমিনার, আলোচনা এবং বক্তৃতা সম্মেলনে আটকে থাকাই কি পরিবেশ রক্ষার একমাত্র উপায় নাকি সরকার এবং মন্ত্রনালয় গুলোর পাশাপাশি জনসাধারণের সচেতনতা এবং নানামুখী পদক্ষেপ বাড়ানোও জরুরি? বিশ্বের যেসব দেশ জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের জনসাধারণ এই বিষয়ে কি ভাবছে। আদৌ তাদের ভাবনায় পরিবেশ এবং প্রকৃতি আছে কি না! অথবা তারা কি জানে তাদের জীবনধারায় কি ধরনের পরিবর্তন আনলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমবে?
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি লাইন এখানে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক –
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর’
সেই অরণ্যকে আমরা কি আর ফিরিয়ে আনতে পারবো তার সেই চিরচেনা রূপে? মানবসভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে প্রকৃতির যথোপযুক্ত সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।’ এই বিষয়টি কি শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব, নাকি আমাদেরও এ বিষয়ে করণীয় আছে?
এই গুরুত্বপূর্ণ দশকে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবর্তন মোকাবিলায় অনেক দ্রুত ও সময়পোযোগী কর্মপরিকল্পনা নেয়া এখনি সময়। অধিক হারে বৃক্ষরোপণ, শিল্পায়নের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাণ-প্রকৃতির সঠিক সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতনতা বাড়ানো,নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, শহরে সবুজ বনায়ন প্রকল্প, নদী এবং জলাভূমি দখল্মুক্ত করে সংরক্ষণ করতে হবে। উন্নয়ন দৌড়ে পরিবেশকে বাধাগ্রস্থ না করে পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এবং পরিবেশ রক্ষায় সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষকে আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। প্রকৃতির উপরেই মানব সভ্যতার অস্তিত্ব টিকে রয়েছে, আমরা যেন নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংস ডেকে না আনি। উন্নয়ন হোক, তবে তা যেন হয় পরিবেশ বান্ধব।
এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হচ্ছে,- তখনও আমাদের চোখে পড়ছে ঢাকার রাস্তায় উন্নয়নের নামে বড় বড় ছায়াদানকারী গাছ কেটে ফেলার খবর। আশাবাদী হই যখন দেখি দেশের তরুন প্রজন্ম এই গাছগুলোকে রক্ষার দাবিতে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে যেন বাকি গাছ গুলো কাটা না হয়। তখন মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের একটি পংক্তি –
“কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ,
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!”
উপরোক্ত সম্পাদকীয়টি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ১০ জুন ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত।
(বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপর্যুক্ত লেখাটি লেখকদের নিজস্ব ভাবনা। তা কোনভাবেই লেখকের কর্মরত প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বা মতামত হিসেবে বিবেচিত নয়।)