পিস ক্যাফে। শব্দ দুটি শুনলেই বোঝা যায় এটা এমন এক ক্যাফে যেখানে শান্তির একটা ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে। সত্যিকার অর্থেই এটি প্রচলিত ধরনের কোনো ক্যাফে নয় বরং তাদের কাজ সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীর ক্ষমতায়ন, উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নারী নিয়ে কাজ এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে সৃষ্টিশীল প্লাটফর্ম হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
ব্যতিক্রমী এ ক্যাফের যাত্রা শুরু ২০১৮ সালে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস (সিপিজে) এবং জাতিসংঘের নারীবিষয়ক কর্মসূচি ইউএন উইমেন যৌথভাবে গড়ে তুলে প্লাটফর্মটি। জাপান সরকারও অর্থায়ন করেছে। বর্তমানে দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিস ক্যাফে সক্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন।
পিস ক্যাফে মূলত একটি বহুমুখী প্লাটফর্ম যা গবেষণা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষাদান কর্মসূচি এবং অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কমিউনিকেশন অফিসার এবং পিস ক্যাফ উদ্যোগের সহ-উপদেষ্টা মো. ওয়াহিদুল ইসলামের মতে, আগে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বা দক্ষতা অর্জনের চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সীমিত ছিল। অন্তত এক হাজার শিক্ষার্থীকে পিস ক্যাফে সে সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের প্রত্যেকে ক্যাম্পাসের বাইরেও নিজ নিজ এলাকায় নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকার, লিঙ্গ সমতা, শান্তি-সম্প্রীতির বিকাশ ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক জ্ঞানদানে কাজ করছে। দেশের প্রায় ২৩টি জেলায় পিস ক্যাফের সদস্যরা এসব ধারণা ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পিস ক্যাফের সদস্য নোশিন ফেরদৌস সামানথা। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘স্পর্শক’ নামক একটি প্রকল্পে কাজ করেছেন। তিনি জানান, তৃণমূল পর্যায়ের চা বাগান কর্মীদের জীবনে যেমন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, ঠিক তেমন নতুন কিছু শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা নেতৃত্বের গুণাবলি বৃদ্ধি করেছি যা ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় পিস ক্যাফের রাফিয়া ইসলাম ভাবনা ও তার দল কাজ করেছে বেদে সম্প্রদায়ের নারীদের নিয়ে। ভাবনা বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সুবিধাবঞ্চিত বেদে সম্প্রদায়ের মানুষের জনজীবন পর্যবেক্ষণ করে করোনাকালীন জনসচেতনতা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, লিঙ্গ সমতা, গুজব ও বিদ্বেষমূলক কথা নিরসনসহ বিভিন্ন সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে একাধিক কর্মশালা, উঠান বৈঠক আয়োজন ও টুলকিট বিতরণের মাধ্যমে তাদের যথাযথ পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।৷ এতে তারা নিজেরা সচেতন হয়ে প্রাপ্ত জ্ঞান নিজ পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীর মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। এভাবে যখন একজন মানুষ নিজে সচেতন হয়ে তার পরিবার ও প্রতিবেশীকে সচেতন করে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নে উদ্যমী হয় তখনই সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যময় পরিবেশ বিরাজ করে।’
এমনই মোট ১৪টি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন পিস ক্যাফের সদস্যরা। কেউবা আদিবাসীদের নিয়ে, কেউ নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে, কেউ নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে। প্রকল্পগুলো আয়োজন করেছে বিভিন্ন ট্রেনিং সেশন, সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। এমনকি ‘ঐকতান’ নামক একটি প্রকল্প প্রকাশ করেছে এ সম্পর্কিত লেখা সমৃদ্ধ একটি বই, যেখানে স্থান পেয়েছে দুই বাংলার লেখকদের বিভিন্ন প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও কবিতা।
সেন্টার ফর পিস আ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান বলেন, ‘দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বয়স অর্ধশত বছর পেরিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে নানা আন্দোলন গড়ে উঠেছে, শক্তিশালী হয়েছে। আগামীর বাংলাদেশে নারীর অবস্থান আরো সুদৃঢ় হতে হবে। এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রয়াসেই কাজ করে যাচ্ছে পিস ক্যাফে। আমরা এটিকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চাই। আমরা শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে চাই, যাতে তারা সমাজের শান্তির দূত হয়ে ওঠে।’
উপরোক্ত ফিচারটি বণিক বার্তা পত্রিকায় ১৯ জুন ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত।
(বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপর্যুক্ত লেখাটি লেখকের নিজস্ব ভাবনা। তা কোনভাবেই তা সেন্টার ফর পিস এন্ড জাস্টিস (সিপিজে), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বা মতামত হিসেবে বিবেচিত নয়।)